Thursday, 7 October 2021

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়ের গল্প-- 'অরুণ' , 'গরুড়' ও 'নাগগণের'


সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়ের গল্প-- 

 'অরুণ' , 'গরুড়' ও 'নাগগণের'

প্রজাপতি দক্ষের দুই কন্যা। ঋষি কশ্যপ মুনির সাথে বিনতা ও কদ্রুর বিবাহ হয়। বিনতা ও কদ্রু ছাড়াও তার আরো দুজন পত্নী ছিলো। তাদের নাম যথাক্রমে দিতি ও অদিতি।

দিতির পুত্রদের নাম ছিল দৈত্য, আর অদিতির সন্তানদের বলা হতো দেবতা। সেইজন্য কশ্যপ মুনি দেবতা এবং দৈত্যকুলের পিতা হিসেবে স্বীকৃত।

বিনতা ও কদ্রুর সেবা ও যত্নে সন্তুষ্ট হয়ে একদিন তিনি দুই পত্নীকে মনোমত বর প্রার্থনা করতে বললেন।  কদ্রু হাজার নাগ সন্তানের মা হতে চাইলেন এবং বিনতা দুই পক্ষী সন্তানের মাতৃত্ব পেতে চাইলেন। কিন্তু বিনতা আরো প্রার্থনা করতেন যাতে তার পুত্ররা কদ্রুর পুত্রদের চেয়েও বলবান হয়। শুনে ঋষি কশ্যপ মৃদু হেসে তাদের বর মঞ্জুর করলেন।

কিছুদিনের মধ্যে মুনির বরে দুজনেই গর্ভবতী হলেন।  যথা সময়ে দুজনের সন্তান প্রসবের সময় হল। তারা দুজনেই ডিম প্রসব করলেন। স্বর্ণের পাত্রে সেইগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হল।

কিছুদিনের মধ্যেই ডিম প্রসবের পর কদ্রুর হাজার নাগ সন্তানের জন্ম হয়ে গেল।

কিন্তু বিনতার দুটি ডিম ফুটে বাচ্চাদের দুনিয়াতে আসার কোনো সংবাদই নেই! বছরের পর বছর এমনিভাবে চলে যেতে লাগল, আর বিনতার মাতৃমন উতলা হয়ে উঠতে লাগল।

বিনতার ডিম্বানুর কিন্তু কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। তা দেখে বিনতা  চিন্তিত হয়ে পড়লেন।  তিনি ভাবলেন, একই সঙ্গে দুই বোনে গর্ভবতী হয়ে একই দিনে আমরা ডিম্ব প্রসব করলাম অথচ কদ্রু শতপুত্রের জননী হল কিন্তু আমি কেন এখনও সন্তান পেলাম না। তিনি হা হুতাশ করতে লাগলেন। খুবই অস্থির হয়ে পড়লেন। মনে মনে ভাবলেন, তবে কি মুনির বর ব্যর্থ হল। বিনতার দুটি ডিম ফুটে বাচ্চাদের দুনিয়াতে আসার যে কোনো সংবাদই মুনিকে দিতে পারছেন না! বছরের পর বছর এমনিভাবে চলে যেতে লাগল। এদিকে বিনতার মাতৃমন ধৈর্যহারা হয়ে পড়ল।

একদিন বিনতার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। তিনি নিজেই তার একটি ডিম ফাটিয়ে ফেললেন। তারপর দেখতে পেলেন, ঐ ডিমের ভেতরে লাল রঙ্গের অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক পাখির মত এক অপরিপক্ক সন্তান। পরিণত হওয়ার আগেই ডিম ভেঙ্গে ফেলার জন্য সেই সন্তান মায়ের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন এবং অভিশাপ দিলেন যে,  “মা তুমি অকালে ডিম ভেঙ্গে আমাকে জন্ম দিয়েছ। আজ আমি এক অপরিপক্ক সন্তান। তাই আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি। বোনের পুত্রদের দেখে তুমি মনে মনে খুবই হিংসা কাতর হয়ে পড়েছিলে।  তাই সেই হিংসার দোষে তাদেরই দাসী হয়ে তোমাকে সারা জীবন কাটাতে হবে।”

বিনতা শুনে খুব কান্নাকাটি করতে লাগলেন। তখন সেই অপরিপক্ক সন্তান -এর মনে দয়া হল, তিনি বললেনঃ  "যতদিন পর্যন্ত না তোমার দ্বিতীয় ডিম থেকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হচ্ছে, ততদিন তুমি তোমার বোনের দাসত্ব করবে। তবে অপর যে ডিম্ব রয়েছে তা থেকে যথা সময়ে এক মহাবীরের জন্ম হবে।  সেই তোমার দাসত্ব মোচন করবে।" এই বলে তিনি হঠাৎ সূর্যের দিকে উড়ে চলে গেলেন। তার নাম হলো অরুণ। তিনি সূর্যের রথের অন্যতম সারথি হলো। প্রতিদিন ভোরে উদিত হওয়া সূর্যের আলোকে আমরা "অরুণালো" বলে অভিহিত করি। এই ঘটনা থেকেই সেই নামের সার্থকতা এসেছে।

বিনতা তার বোন কদ্রুর সাথে পাশা খেলায় হেরে যান এবং শর্তানুসারে তাকে কদ্রুর দাসী হয়ে থাকতে হয়। এভাবেই বিনতার প্রতি দেওয়া তার সন্তানের অভিশাপ ফলল।

এরপর বহু বছর কেটে গেলে, বিনতার দ্বিতীয় ডিম থেকেই যথাসময়ে পক্ষীরাজ গরুড়ের জন্ম হয়। একেবারে তেড়েফুঁড়ে ডিম ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে গরুড় ক্রোধন্মত্ত হয়ে মহাবিশ্বে ধ্বংসের তাণ্ডব চালাতে থাকলেন। তিনি আকাশে উড়ে গেলেন, তাই তার নাম হল গরুড়। তার এই বিপুল ধ্বংসলীলা দেবতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারল না। কিন্তু গরুড়ের বিশাল আকৃতি ও শক্তি দেখে তার প্রতি দেবতাদের ভয় জন্মাল। তারা গরুড়ের কাছে শান্তির জন্য প্রার্থনা করলেন। সন্তুষ্ট হয়ে গরুড় তার আকার ও শক্তির পরিমাণ কমিয়ে আনলেন। এতে দেবতারাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি সর্প কূল থেকে মাতাকে উদ্ধার করেন।  এজন্য  তাকে দেবতাদের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হয়েছিল। এই সময়েই এক  অদ্ভুত কারণে সমস্ত সাপের জিভ চিরে গিয়েছিল।

সমুদ্রের অতল গহ্বর থেকে অমৃত উদ্ধার করার জন্য দেবতা ও অসুরেরা মিলে সমুদ্র মন্থন করলেন। অমৃতের সঙ্গে পাতাল থেকে উঠে এল মহা মূল্যবান রত্নরাজি, অপ্সরাগন, লক্ষ্মীদেবী, ঐরাবত, উচ্চৈঃশ্রবা, পারিজাত বৃক্ষসহ হলাহল নামক বিষ। জগতের মঙ্গলের জন্য মহাদেব সেই বিষ পান করে নীলকন্ঠ হলেন।  সমুদ্র মন্থনে উঠে আসা উচ্চৈঃশ্রবা ঘোড়ার লেজের রং কী তাই নিয়ে কদ্রু ও বিনতার মতবিরোধ দেখা দিল। কদ্রু বললেন ঘোড়ার লেজের রং কালো আর বিনতা বললেন সাদা। তখন দুই বোন শর্ত রাখলেন পরদিন উচ্চৈঃশ্রবাকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে কার কথা ঠিক। যে এই বাজিতে হেরে যাবে সে অপর জনের দাসী হয়ে থাকবে। কদ্রু যে কোনো প্রকারে এই বাজি জিততে চেয়েছিলেন। তাই তিনি নিজের সর্পপুত্রদের গোপনে ডেকে বললেন, কাল যখন ঘোড়া পরীক্ষা করা হবে তোমরা এমন ভাবে উচ্চৈঃশ্রবার লেজে জড়িয়ে থাকবে যেন তাকে কালো বলে মনে হয়। সাপেরা মায়ের এই অন্যায় আদেশ পালন করতে অস্বীকার করল। তখন কদ্রু পুত্রদের অভিশাপ দিলেন যে তাদের জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে দগ্ধ হতে হবে। পরে সাপেরা মায়ের আদেশ পালন করা উচিত মনে করে উচ্চৈঃশ্রবার লেজকে বেষ্টন করে থাকল। পরদিন তারা ঘোড়া্র লেজ পরীক্ষা করতে গেলেন। তারা দূর থেকে ঘোড়ার লেজ কালো রংয়ের দেখলেন। শর্তে হেরে গিয়ে সর্পকুলের দাসী হলেন বিনতা। মাকে দাসী রূপে দেখে গরুড় অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে সাপদের কাছে গিয়ে তাকে মুক্তি দেওয়ার অনুরোধ করলেন। তখন নাগ গন বললেন, গরুড় যদি দেবতাদের কাছ থেকে অমৃত নিয়ে এসে তাদের দিতে পারেন তবেই তারা বিনতাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেবেন। অমৃতের সন্ধানে স্বর্গের দিকে উড়ে চললেন গরুড়। দেবতারা প্রবল পরাক্রমে তাকে বাধা দিলেন। অমৃতের রক্ষক ছিলেন বিশ্বকর্মা। ঘোরতর যুদ্ধে তিনি পরাজিত হলেন। ঘুর্ণয়মান লৌহচক্রের মাঝ থেকে সুকৌশলে অমৃত নিয়ে আকাশ পথে ছুটে চললেন গরুড়। হাতের মুঠোয় অমৃত পেয়েও লোভ সংবরণ করে নিজে তা পান করলেন না। ভগবান বিষ্ণু গরুড়ের প্রতি অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে তাকে বর দিতে উপস্থিত হলেন। ভগবান বিষ্ণুকে প্রণাম করে গরুড় বললেন, “হে ভগবান আপনি আমাকে এই বর দিন আমার স্থান যেন আপনার চেয়েও উপরে হয়। আর আমি যেন অমৃত পান না করেও অমর হতে পারি।”

ভগবান বিষ্ণু বললেন, “তথাস্তু, আজ থেকে আমার রথের চূড়ায় চিরকালের জন্য তোমার স্থান হবে।”

এইবার গরুড় বললেন, “ভগবান, আমাকে আপনার উপরে স্থান দিয়েছেন। এতে আমি অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করছি। তাই আমিও আপনাকে বর দিতে চাই। বলুন আপনি কী বর চান? ভগবান বিষ্ণু বললেন, “হে পক্ষীরাজ আজ থেকে তুমি আমার বাহন হও।” শুনে গরুড় বললেন, “তাই হবে প্রভু।”

বিষ্ণুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফেরার পথে দেবরাজ ইন্দ্র তাকে আক্রমন করলেন। অমৃত রক্ষা করার জন্য গরুড়ের উপর বজ্র নিক্ষেপ করলেন। গরুড় মৃদু হেসে বললেন, “হে দেবরাজ ত্রিভূবনের কোনো অস্ত্রেই আমাকে ঘায়েল করা যাবে না। তবুও যেহেতু এই বজ্র তৈরি করা হয়েছে মহাত্মা দধীচি মুনির হাড় দিয়ে তাই তার এবং আপনার সম্মান রাখতে আমি আমি আমার একটি পাখা ত্যাগ করলাম।”

গরুড়ের মহত্বে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্র বললেন, “হে পক্ষীশ্রেষ্ঠ তুমি মহান। আমি তোমার সঙ্গে মিত্রতা করতে চাই।” তখন থেকে তারা দুজন পরম বন্ধু হলেন।

দেবরাজ জানালেন, “এই মহামূল্যবান অমৃত যদি বিষাক্ত সাপেরা পান করে তবে ত্রিভূবনের বিনাশ নিশ্চিত।”

তখন গরুড় বললেন, দেবরাজ আমার কিছু করার নেই। মায়ের দাসত্ব মোচনের জন্য আমি অমৃত নিয়ে যাচ্ছি। তবে একটা উপায় হতে পারে। আমি নাগদের হাতে অমৃত তুলে দেবার পর আপনি তা হরন করে নিয়ে আসতে পারেন। এতে ইন্দ্র খুশি হয়ে গরুড়কে বর দিতে চাইলেন। গরুড় বললেন, “দেবরাজ, দুষ্ট সর্পকুলের জন্য আমার মা আজ দাসীর জীবন যাপন করছেন, আপনার বরে সাপেরা আমার খাদ্য হোক। ইন্দ্রের বর পেয়ে অমৃত নিয়ে তিনি নাগদের কাছে উপস্থিত হলেন। কুশাসনের উপর অমৃতভান্ড রেখে সর্পদের বললেন, এই রইল অমৃত। সকলে একসঙ্গে স্নান করে এসে শুদ্ধ হয়ে অমৃত পান করো। এবার আমার মাকে মুক্তি দাও।”

নাগগন বিনতাকে মুক্ত করে দিয়ে উত্‍ফুল্ল হয়ে সবাই একসঙ্গে স্নান করতে গেল। গরুড় মা বিনতাকে নিয়ে প্রস্থান করলেন। দেবরাজ ইন্দ্র এতক্ষণ আড়ালে থেকে সবকিছু নজর রাখছিলেন। সাপেরা স্নান করতে যাওয়া মাত্রই ইন্দ্র অমৃত নিয়ে স্বর্গে পালিয়ে গেলেন। স্নান সেরে ফিরে এসে সাপেরা দেখল অমৃত নেই। তারা পাগলের মত ছুটে এসে কুশের আসন চাটতে লাগল, যদি পাত্রের গা বেয়ে দু এক ফোঁটা অমৃত নিচে পড়ে থাকে এই আশায়। কিন্তু দ্রুত তীক্ষ্ণ কুশের ডগা চাটতে গিয়ে তাদের জিভ চিরে গেল। সেই থেকে সমস্ত সাপের জিভ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে আছে 

হিন্দু ও বৌদ্ধ পুরাণে উল্লিখিত গরুড় একটি বৃহদাকার পৌরাণিক পাখি বা পক্ষীতুল্য জীব। গরুড় শব্দের অর্থ বাক্যের ডানা। তিনি বৈদিক জ্ঞানের প্রতীক। গরুড় কখনো মুক্তডানা ঈগলের মত, কখনো ঈগলমানবের মত বর্ণনা করা হয়েছে। গরুড় হলেন সাপেদের পরম শত্রু।

গরুড় মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের জাতীয় প্রতীক।

-সমাপ্ত-

 

No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয়--

সম্পাদকীয়--   চলমান জীবনের নিয়ম সৃষ্টির বাঁধনে বাঁধা। সাহিত্য মানুষের সুখ-দুঃখ ভাব ভাবনা স্মৃতি স্বপ্ন সবকিছু মিলিয়ে সৃষ্ট হয়। আর এ সব কি...