Monday 4 October 2021

ইন্দ্রানী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা-- ১ এসো আলো,এসো প্রেম ২ অথ গল্পকথা, ছোট গল্প--শাশুড়ি


ইন্দ্রানী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা--  

 

এসো আলো,এসো প্রেম 

 

ভালো তো তাকেই বাসি

যার মধ্যে আছে আগুন

ওই যে সূর্যটা

ওটাকে ভালোবাসি।

 

জানোই তো

বীরের পূজারী আমি

কতবার নতজানু আমি

তেজ আর পৌরুষের কাছে।

 

সকাল হলেই

গন্ধে মাতাল করে ফুলেরা।

পাখি গুলো গেয়ে ওঠে।

আলো মানেই তেজ

তাই তো তোমার 

আলোকদূত নাম।

আলো মানেই ভালোবাসা

আলো মানেই তুমি।

 

২ 

অথ গল্পকথা

 

আড়ালে রয়ে গেছে

পৃথিবীর কিছু গল্প।

সেটাই এবার শোনাবো

ক্লাইমেক্স আছে অল্প।

 

সব গল্পে থাকবে না প্রেম

শুধুই মিলনগাথা।

রাহাজানি আছে

আছে প্রতারণা

না বলা গোপন কথা।

 

হাতছানি আছে

বিশাল বিপুল

ভ্রষ্টাচারের পথ।

বিয়োগব্যথায়

মন হারানোর

অদ্ভুত কেরামত।

 

যেসব গল্প

কেউ পড়ে নি কো

ছাপানো হবে না পাতায়

মুখের আড়ালে

মুখোশের খেলা

অথ গল্পকথায়।

 

ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়র ছোট গল্প--

শাশুড়ি 


এই বাড়ির সব নিয়ম চলে ব্রজসুন্দরীর তত্ত্বাবধানে।নামের সাথে দেহের সৌন্দর্যের মিল নেই।আবার অনেকে বলে থাকেন মানুষের প্রকৃত সৌন্দর্যের অধিষ্ঠান তার মনে।সেদিক থেকে ব্রজসুন্দরী একশতে একশ।এই যৌথ পরিবারের সর্বময়ী কত্রী ব্রজ।ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙে যায়।শুরু হয় রুটিন মাফিক সব কাজ।

ভোরে স্নান করে ফুল দুর্বা তোলে ব্রজ।তখনও বড়বৌ মেজবৌ ওঠে না।এবাড়িতে বুড়ো কর্তা আর বড়ছেলে থাকে।চারটে ঘর।সাথে রান্নাঘর,ভাঁড়ার ঘর।বাড়ির পিছনে খিড়কি পুকুর।মাছেজলে হয়ে আছে।একটু পরেই কর্তা ঘুম থেকে উঠবে।ফুল দুর্বা তুলসীর মন্ডপে রাখলে ব্রজ।পিছন ফিরে দেখে বড়বৌ ।বললে "আজ কত সকালে উঠেছেন মা।এখন এই পাঁচটা বাজছে"।

ব্রজ অবাক হয়।বলে "সেকি!আমি যে দেখলুম পাঁচটা বাজছে।"

ঘুম থেকে উঠে ঘড়ি দেখে ব্রজ।এত ভুল কোনোদিন হয় নাতো।

বাইরের সদরে দেওয়াল ঘড়িতে ঢঙঢঙ করে পাঁচটা ঘন্টা পড়ল।


সংসারে কাজ সব ভাগ করা আছে।বড়বৌ নিজের কাজে মন দিল।শাশুড়ির আওয়াজ পেয়ে ও ভেবেছিল অনেক বেলা হয়ে গেছে।উঠেই ঘোমটা দিয়ে মাথা ঢেকে ঝাঁট দেওয়া শুরু করল।উঠোন,দুয়ার আর খিড়কি কিছু বাদ গেল না।


ঘরের ঝাঁট পরে হবে।ছেলেপুলেরা ঘুমুচ্ছে।সরায় করে গোবরমাটি এনে দুটো দরজায় লেপে দিলে।এখনি শ্বশুর মশাই উঠবেন।বড় বড় বালতিতে জল ভরে দিতে হবে।ও বাড়িতে এখনো কেউ জাগে নি।


ব্রজ নিজের ঘর ঝাঁট দেয় সকাল হলেই।বিছানা থাকে পরিপাটি।বড়বৌকে বললে "তোমার বাবার স্নানের জল তোলা হয়ে গেলে তুমিও স্নান করে নিও।আজ নাগপঞ্চমী।মনসার পুজো দিও ধর্মঘরে।কতকরে বলেছি দয়ালকে ঢেঁড়স,কচু আনবি না।নাগপঞ্চমীতে ওসব খায় না।আচ্ছা হুঁশো ছেলে।"

বড়বৌ ঘাড় নাড়ে।শ্বশুর উঠে প্রাত্যহিক কাজ সেরে স্নান করে নেয়।তারপর ভাঁজকরা পাটের কাপড় আর উত্তরীয় এগিয়ে দেয় ব্রজ।কর্তা বলে "আজ অরুণ আসবে নাকি!"

ব্রজসুন্দরীর মুখটা চকচক করে।বলে "হ্যাঁ।আসার তো কথা।আজ তো শনিবার"।


এতক্ষণে মেজবৌ আর সেজবৌ এবাড়িতে এসে পড়েছে।দুজনেই খুব সুন্দরী।ওরা সামনের নতুন বাড়িতে থাকে।উপর নীচ মিলিয়ে ছটা ঘর করেছে কর্তা।বাকি ছেলেরা ওখানে থাকে রাত্রিতে।তবে খাওয়া দাওয়া সব এবাড়িতে।রান্নার ঝক্কি সামলায় মেজবৌ।এসেই কয়লার উনানে আঁচ দেয়।শ্বশুর শাশুড়ি চলে গেছে গৃহদেবতার পুজো করতে।পাঁচকেজি চালের হাঁড়ি চাপে আঁচ উঠলে।সেজ বৌ স্টোভে চা বসায় বিরাট একটা সসপ্যানে।ঘরের গরুর দুধ।ঘনদুধের চা খায় সব।


ভাতের মধ্যে আলু দিল মেজবৌ।সেজবৌ রতন বললে "ওই অত আলু মেজদি!"

মেজবৌ সন্ধ্যা হাসতে থাকে।বলে "তাতেও কুলোলে বাঁচি।"

সেজবৌ হাসতে হাসতে চা তৈরিতে মন দেয় ।গজগজ করে আপনমনে "এটা সংসার না রাহুরাক্ষস।যা রান্না করো ঠিক কুলোবে না"।

মেজবৌ জানে সেজোর মুখে রাখঢাক নেই।তবে মনটা বড়ো সাদা।বললে "চা হয়ে গেলে মাছগুলো বেছে দিস সেজো।ছেলেরা ইস্কুলে যাবে।কর্তা অফিস যাবে।শুধু আলুসিদ্ধ দিয়ে তো আর ভাত দিতে পারিনা।ডাল বসাচ্ছি ভাত নামিয়ে ।আর মাছ গরম গরম ভেজে দিলে তোফা খাওয়া।


    


বাড়ির সবাই কর্তাকে সমীহ করে চলে।ছেলেরা ভয়ে জুজু।পান থেকে চুনখসার উপায় নেই।ভীষণ রাগী মানুষ।তবে এলেম আছে লোকটার এটা সবাই স্বীকার করে।দালানকোঠা বানিয়েছে ছটা।জমিজমা প্রায় একশ বিঘে।সাতটা পুকুর।গোয়াল ভর্তি গাই আর বলদ।মেজবৌ সেদিন বললে "বাবা হলেন কড়ি কপালে পুরুষ মানুষ।"


যথাসময়ে ভাত নামলো।বড় ডেকচিতে ফ্যান গাললো মেজবৌ।আলু গুলো একটা বড়ো সানকিতে রাখলে।বড়বৌ পূজার থালা সাজাতে সাজাতে বললে "ও সন্ধ্যা।গরম থাকতে আলু মাখো।নৈলে বড়ো বিস্বাদ লাগে"।

মেজবৌ সন্ধ্যা রাঁধতে ভালোবাসে।বললে "এই যে এখনি মাখবো।আপনাকে গরদের শাড়িতে জগজ্জননী লাগছে বড়দি।পুজো নিয়ে যাচ্ছেন।একপো দুধ মনসার পুজোয় দিতে পারতেন তো"।

বড়বৌ হেসে জবাব দেয় "তুমি মনে করছো মা দেয়নি।সকালে টন্টু গয়লা এসে গাই দুয়েছে।মা আগেই বলে রেখেছিলেন কিনা।"


একে একে ঘুম থেকে সবাই উঠে পড়েছে।সেজো ছেলে চালকল চালায়।জাবদা খাতায় হিসাব রাখে কর্তা।বৌ চা করছে দেখে দয়ালকে ডেকে বললে "ও দয়াল।বুধো মোড়লের দোকানে আমার নাম করে বলবি সেজোকাকা দশটা পাউরুটি চাইলে।ছুটে যা"।


দয়াল ব্রজসুন্দরীর বড়নাতি।ওর বয়স চোদ্দ।সকলের ফাইফরমাশ এখন দয়াল করে।ব্রজ রাগ করে।বলে "দয়ালকে তোরা কোনো কাজ বলবি না।ওর লেখাপড়ার ক্ষতি হয়।

সেজোকাকা পাউরুটি আনতে বললেও দয়াল ইতস্ততঃ করে।কাকাকে বলে "রোজ পাউরুটি আনতে গেলে দোকানদার মুখের দিকে এমন হাঁ করে তাকায়"।

এরমধ্যেই ব্রজসুন্দরী পুজোর প্রসাদী ফুল নিয়ে চলে আসে।সকলের মাথায় ঠেকিয়ে বলে "পাঁউরুটি রোজ বিনে পয়সায় আনতে পাঠাস কেন শ্যাম।বুধোর অল্পপুঁজির দোকান"।

বস্তুত চালকলের পাশের ছোট্টঘরটা বুধো ব্রজসুন্দরীকে বলে চা এর দোকান করেছে।বলেছে কিছু ভাড়া আমি দেবো।নতুন দোকান।সেখানে প্রতিদিন যদি পাঁউরুটি দিতে হয় তাহলেই হল।ব্রজ দয়ালকে টাকা দেয়।বলে "যা দলু।কিনে আন গে"।

দয়াল অপেক্ষা না করে একছুটে চলে যায়।


এই বাড়িতে মোট কুড়িজন সদস্য।এর সাথে বাড়ির ঠিকে ঝি তিনটে।মাঠের মুনিষ প্রতিদিন পাঁচজন।সাথে আত্মীয় কুটুম্বে গমগম করে ব্রজসুন্দরীর হোটেল।

কর্তা মেজবৌ ছাড়া কারো হাতের রান্না পছন্দ করেন না।মেজবৌকে সাহায্য করে স্বয়ং ব্রজ ।কর্তার ভাত বাড়তে হবে অতি সন্তর্পণে।একটা চুল যদি ভাতে পড়েছে তবে সেদিন কুরুক্ষেত্র।


মেজছেলে অফিস যাবে।নটার ট্রেন।সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে গিয়েছিল জমির কাজ দেখতে।একটা আধটা জমি তো নয়।কাজ লেগেই থাকে।ওখান থেকে এসে স্নান ঘরে ঢুকেছে।সেজো বৌ ছেলেমেয়েদের স্নান করাচ্ছে সামনের চাতালে।এরা ইসকুল যাবে।এরপর সার দিয়ে খেতে বসবে।সেজো বৌকে তখন ছোটোদের মাছের কাঁটা বেছে দিতে হবে।দুষ্টুমি করলেই পিঠে তাল পড়বে।


সকালের পর্ব মিটলো।ব্রজসুন্দরী বললে "আজ অরুণ আসবে"।

মেজোবৌ মাছের কড়া সরিয়ে একপাশে রাখলে।শ্বশুর নিরামিষভোজি।তাই বাইরের উনানে মাছ রান্না হবে।এই উনানে গোবর মাটি লেপা হল।জলখাবার খেলে দেওররা।সকালের পাঁচকেজি চালের ভাত উঠে গেল জলখাবার খেতে।এরপর আবার বসল পাঁচকেজি চালের হাঁড়ি।বাড়ি এখন অনেক টাই ফাঁকা।

এরমধ্যে সেজোবৌ এর বাবা এসে হাজির।ব্রজ ঘোমটা টানলে মাথায়।বললে "বেয়াই মশাই।বাড়ির সব কুশল তো"?

শিবাণী গাঙ্গুলি হাসলে।বললে হ্যাঁ সব ঠিক আছে।লোকটার অদ্ভুত বাতিক।বাড়িতে পাখি,বেড়াল বেজি কি না নেই।এখন আবার খরগোশ পুষেছেন।বেশিক্ষণ থাকবেন না।তবে রতনকে দেখতে চলে আসেন।পাড়ার লোকে শিবাণীর নাম দিয়েছে খ্যাপা বাউন।ব্রজকে এদের নিয়ে চলতে হয়।


   ব্রজসুন্দরীর ছটা ছেলে।তিনজনের বিয়ে হয়েছে।বাকিরা পড়াশোনা করছে।একটা মেয়ের বিয়ে দিয়েছে রাজকীয় আড়ম্বরে।বড়ছেলে অরুণ রেলের কর্মী।শনিবার বাড়ি আসে।রবিবার চলে যায়।মেদিনীপুর এ রেলের কোয়ার্টার এ থাকে।বড়বৌ এখানেই থাকে দুই ছেলে নিয়ে।তিনটে বৌ এর শাশুড়ি ব্রজ।সবাই বলে "অরুণের মা সংসার করছে বটে।বৌদের ঠিক বাগে রেখেছে"।


ব্রজসুন্দরীর আজকাল মনে হয় অরুণটা সুখী হয় নি।অরুণের এটা দ্বিতীয় পক্ষ।প্রথম বিয়েটা হয়েছিল চক এ।কী মিষ্টি ছিল মেয়েটা।শ্যামলা রঙ,এক পিঠ চুল,ডাগর ডাগর চোখ।কেন যে মরতে গেল।ওইসব দিনের কথা ভাবলে মাতৃহৃদয় হাহাকার করে ওঠে।


মেজো বৌ এর ডাকে সম্বিত ফিরে পেল ব্রজ।মেজোবৌ বললে "উদাস হয়ে কী ভাবছেন মা।সকাল থেকে কিচ্ছুটি দাঁতে কাটেন নি।আমি চালকলে বাবার কফি আর কুমড়ো ফুলের বড়া দিয়ে মুড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি মা।আপনি এবার খেয়ে নিন।"

ব্রজসুন্দরী মৃদু হাসে।বলে "হ্যাঁ মা।খাচ্ছি।তোমরা তিনবৌ খেয়ে নাও।তারপর কাজ করো"।


আবার রান্না হবে।ব্রজ বললে "ফুলকপি আর চন্দ্রমুখী আলুর পোস্ত হোক।ডাঁটা,উচ্ছে বড়ি কাচকলা সব যখন আছে তবে শুক্তো কুটে দিই।তোমাদের বাবার তো আবার ঘনদুধের সাথে আলুভাতে চাই শেষপাতে।আর সব রান্নার শেষে মাছ কোরো।আর সেজো বৌমা যেন মাছগুলো সব বাইরের উঠোনে ভেজে ফেলে।নৈলে নষ্ট হয়ে যাবে।"


খাওয়া দাওয়া চলতে চলতেঈ নাতি নাতনিরা হাজির।ব্রজ চিৎকার করে "যা।যা।আগে হাতপা ধুয়ে আয়।"

ছোট নাতি প্রাইমারিতে পড়ে।বলে "ঠাম্মা।কাল পনেরই আগস্ট।স্বাধীনতা দিবস।সকালে ফুলমালা নিয়ে ইসকুল যাবো"।


দুপুরে ঘুমাতে গিয়ে ব্রজর মনে পড়ে সেই কবেকার কথা।সালটা তখন ১৯৪২।সারা ভারতের নেতা গান্ধীজি।সকলের মুখে এক কথা "করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে"।


তখন ব্রজ এখন কার হিসেবে কিশোরী।ছোট্ট ছোট্ট শাড়ি পরতো তখন।ভিতরে থাকতো ইজের।বেশ মোটা চেহারা।গায়ের রঙ কালো।বাবা দাদাদের চিন্তার কারণ ছিল ব্রজ।তবে ব্রজ ঠিক করেছিল ওর যখন বিয়ে হচ্ছে না তখন নার্সের কাজ করবে।শুনে তো সবাই আকাশ থেকে পড়ল।বাবা বললে "এ মেয়ে বলে কি"!


সে আজকের কথা নাকি!ভারত তখন পরাধীন।দাদারা গোপনে স্বদেশী করতো।রেডিও তে খবর শুনলো ব্রজ।বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনীর কথা শুনতো।তারপর একদিন শুনলো বীর নেতার আহ্বান "তোমরা আমাকে রক্ত দাও।

আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো"।

এসব কথা ব্রজ আজ ভাবছে।দেশ এখন স্বাধীন।আঠারো বছরের ব্রজ এসব দেখেছে চোখের সামনে।আজকাল কত কী ভাবে ব্রজ।বৌ দের বলে "তোমরা হলে মা কল্যাণী।তোমাদের পবিত্র স্পর্শ সংসারে ফসল ফলায়"।

বৌরা অবাক হয়ে যায় শাশুড়ির কথায়।


    


আজকাল ব্রজ অনেক কিছু ভাবে।তাদের কালে বাঙালি মেয়েরা জন্মাতো শুধু বিয়ে আর সন্তান উৎপাদনের কাজে ।এখন অনেক বদলে গেছে সবকিছু।ওর যখন বিয়ে হল তখন ওর শাশুড়ি বেঁচে নেই।তবে জা জেউলিরাই কম কি?

পালকি করে বৌ এসেছিল।কারা যেন হাসতে হাসতে বলেছিল "ওরে বাবা!পালকির ওইটুকু খোপে এই গন্ধমাদন কী করে বসেছিল!


খুব কান্না পেয়েছিল ব্রজর।তারপর একটা হাতল দেওয়া চেয়ার যখন ওর দিকে এগিয়ে দিল বড় ননদ তখন ওতে ধরলোই না ব্রজসুন্দরীর কোমড়।


কর্তার নাম ধরে ডেকে কী হাসি তার।বললে "যা বৌ এনেচিস ।সাতটা শেয়ালে খেতে পারবে না।


ব্রজ ভাবে "অশিক্ষিতরা নারীর রূপের কদর করে।এই তো সেদিনের কথা।মেজ বৌ এর যমজ মেয়ে হল।সবাই কত কি বললে।ওরে বাপরে!একসাথে দুটো মেয়ে।মেজবৌ ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল শাশুড়ি কি বলবে কি জানি!আর যখন ব্রজ গিয়ে দুই নাতনির হাতে দুটো সোনার বালা পরিয়ে দিয়ে কপালে চুমু খেলে তখন আনন্দের বান ডেকে গেল।জন্মটা অত ফ্যালনা নয় বুঝিয়ে দিলে সবাই কে।


অরুণের প্রথম বৌটা গয়নার কারণেই মরলো।বাপ মা মরা মেয়ে।দাদাদের সংসারে ছিল।কর্তা কথা দিলে এই মেয়েকে পুত্রবধূ করবো।বিয়ে হল।কোনো পন চায়নি ব্রজ।দাদারাই কয়েকটা গয়না দিয়েছিল।অষ্টমঙ্গলার পর যখন বাপের বাড়ি গিয়ে বললে আমার শাশুড়ি এত্ত ভালো তখন বৌদিরা বললে "তবে এক কাজ কর ছবু।গয়না গুলো দিয়ে যা"।

ছোট্টমেয়ে একবার মুখ ফুটে যদি বলতো।পরের বারে যখন আবার দাদার বাড়ি গেল বৌদিরা গয়না কেড়ে নিলে।ছবু ভাবলে শ্বশুর বাড়ি মুখ দেখাবো কি করে।আর তারপর গলায় ফাঁস লাগালে।


কর্তা খবর পেয়ে যখন গেল তখন নিথর শরীর পড়ে আছে।আর একুশ বছরের অরুণ সেই যে সংসারের নিদারুণ আঘাত পেলে আর ঠিক হল না।

পুরোনো কতদিন আগের কথা।ব্রজ ভাবে।এই যে বৌ গুলো ওদের বাবা মা ছেড়ে ওর সংসারে এসেছে।ওদের অনেক ভালোবাসা দিতে হবে।ভালোবাসা সব পারে।হৃদয়ের রত্ন ওটা।


বিকেলে অন্নর মা মুড়ি ভাজতে এসেছে।মোচা সিদ্ধ করেছে বড়বৌ।ব্রজ উঠে গেল।সেজো বৌকে বললে স্টোভটা ধরিয়ে দাও।


শুকনো খোলায় জিরে আর শুকনো লঙ্কা ভেজে নিলে ব্রজ।তারপর আলুসিদ্ধ আর মোচাসিদ্ধ মেখে ওই মশলা মিশিয়ে গরম গরম চপ ভাজলে।অরুণ এতক্ষণে পৌঁছালো।বললে "উরিব্বাস!চপ আর গরম মুড়ি।দারুণ!"

নাতি নাতনিদের মধ্যেও আনন্দের বন্যা।এদিকে বলা নেই, কওয়া নেই।মেঘ করেছে আকাশে।বৃষ্টি নামলো বলে।অরুণ বাড়ি ফেরার পথে বাজার করে এনেছে।বাঁধাকপি এনেছে।ব্রজসুন্দরী ডাক দিল "ও সেজো বৌ।হাঁসের খোল থেকে ডিম গুলো বের করে আনো"।


     সেজোবৌ এর আজ খুব আনন্দ।একটা মাটির হাঁড়িতে ভর্তি ডিম এনে একপাশে রেখেছে।এ বাড়িতে হাঁসের ডিম রান্না হয়।তবে মুরগীর ডিম বা মাংস কিছু ঢোকে না।মাংস খেতে হলে ওইবাড়িতে রাঁধতে হবে।তাও খাসির মাংস।

সকলের মুড়ি খাওয়া হল।চালকলে চপ আর মুড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল।সেজো ছেলে,কর্তা বাদ দিয়েও কর্মচারীদের পর্যন্ত।তেলের তো অভাব নেই।সরষে ভানিয়ে নিলেই তেল।আজ যেন বাড়িতে উৎসব।ব্রজসুন্দরীর রান্না মানেই চমক।মেজো বৌ ভাত চাপিয়েছে।ব্রজ বললে "শোনো গো মেজবৌ।এই স্টোভে আমি বাঁধাকপি ডিম দিয়ে রাঁধছি।তুমি তোমার শ্বশুরের জন্য পোস্ত বেটে বড়া করে তরকারি করে দাও।আর বেগুন ভেজে আলুভাতের সঙ্গে মেখে দাও।একটু ডাল করো।ওটা সবাই খাবে"।


সেজো বৌ বললে "বেশি করে করবেন মা।যেন সবাই পায়।সবাই খাওয়ার পর আমার থাকে না বেশি।"

ব্রজ হাসতে থাকে।বলে "তুমি আমার পাগলী মেয়ে"।

ব্রজ বড় একটা টিফিন কৌটো বার করে।বলে "সেজো বৌমা।ডিমগুলো এই কৌটোর মধ্যে ফাটাও।ওতে নুন আর গোলমরিচ দাও"।

বড়বৌ বাঁধাকপি কুটছে।শাশুড়ি চেঁচিয়ে বললে "শক্ত অংশ দিও না।আর খুব সরু করে কাটবে"।


বাঁধাকপি কেটে মশলা করতে বসলে বড়বৌ।আজ খুব সুন্দর পরিপাটি করে সেজেছে।অরুণ যেদিন আসে সেদিন ও সাজে।খুব শান্ত আর নিরীহ এই বড়বৌ।

ব্রজ বাঁধাকপি ভাপিয়ে নিয়ে টিফিন কৌটে ডিমের সাথে মিশিয়ে নিল।তারপর মাটির হাঁড়িতে জল বসিয়ে টিফিন কৌটো মুখ এঁটে রাখলো।বেশ কিছুক্ষণ ফোটার পর বেশ পনিরের মতো বসে গেছে।বের করে পিস কাটলে ছুরি দিয়ে।


নাতি নাতনিরা গোল হয়ে বসে আছে।কেউ পড়তে যায়নি আজ।অরুণ একবার ধমক দিলেও নড়েচড়ে না।ওরা ভাবছে আজ ভয়ঙ্কর রকমের ভূরিভোজ।দয়াল হাত পাতে "ও ঠাম্মা।ওই ডিমের বড়া একটু দাও"।

একটা বড়া টুকরো টুকরো করে নাতি নাতনিদের মুখে পুরে দেয় ব্রজ।একটা অনাস্বাদিত আনন্দে হৃদয় ভরে ওঠে।মনে ভাবে "আমার থেকে এরা সবাই এসেছে।আমি সেই আদি বৃক্ষজননী।আর এরা আমার ডালপালা।একেই বলে গুষ্টিসুখ"।


বৃষ্টি এসে আবহাওয়া ঠাণ্ডা করে দিলে।রান্না হয়ে গেলে গল্প বলে ব্রজসুন্দরী।শ্রোতা অনেক।নাতি নাতনিদের আবদার কম নাকি!কে শুনবে রামায়ণ, কেউ মহাভারত আবার কেউ বা ভূতের।

রাতে খাওয়া দাওয়া মিটে গেলে অনেকেই ওবাড়িতে চলে গেল।মেজবৌ এখনও যায় নি।ব্রজ গেল কলতলায়।কিন্তু কে জানতো ওখানে অপেক্ষা করছিল বিপদ।পিছলে গেল ব্রজ।একটা মর্মভেদী চিৎকার শুনতে পেল অরুণ।ছুটে গেল কলতলায়।আকুল জিজ্ঞাসা "কী হয়েছে মা।"

মেজবৌ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।বললে "মাগো।কী হল।কেন গেলেন মা অন্ধকারে।"

চিৎকার চেঁচামেচিতে তখন সবাই হাজির।ব্রজসুন্দরী অজ্ঞান হয়ে গেছে।মেজোছেলে ছুটলো ডাক্তার ডাকতে।ব্রজর সাজানো বাগানের সব গাছ তাকিয়ে আছে আকুল হয়ে।

ডাক্তার বলল "এ যাত্রায় রক্ষা পেলেন।তবে পা এর হাড় ভেঙেছে মনে হচ্ছে।এক্স রে করতে হবে।"

ডাক্তার চলে গেল।জ্ঞান ফিরেছে ব্রজর।কাতর নয়নে দেখলে সবাই ওর জন্য উদগ্ৰীব।

নিজেকে আজ খুব দামী মনে হল।ভালোবাসা বৃথা যায় নি।


সমাপ্ত

 

1 comment:

সম্পাদকীয়--

সম্পাদকীয়--   চলমান জীবনের নিয়ম সৃষ্টির বাঁধনে বাঁধা। সাহিত্য মানুষের সুখ-দুঃখ ভাব ভাবনা স্মৃতি স্বপ্ন সবকিছু মিলিয়ে সৃষ্ট হয়। আর এ সব কি...