Sunday 3 October 2021

সন্ধ্যা রায়ের গল্প--চাঁদের মা সারদা

সন্ধ্যা রায়ের গল্প--চাঁদের মা সারদা


আমি করোনা ক্যাবিনে শুয়ে আছি। আমি এখন একটু ভালো আছি। দিন পনের ধরে আমি হসপিটালে। এখানে কত পেশেন্ট আসলো আর কত পেশেন্ট গেল এই পনের দিন ধরে তা আর গুনতে পারিনি। কদিন আগে রাতের বেলা একটা পেশেন্ট মারা গেল। আমি শুয়ে শুয়ে দেখলাম। দুর্বল শরীর উঠতে পারছি না। চোখটা খোলা। তখন আমার জ্ঞান কিন্তু পুরোপুরি আছে। এখানে হসপিটালে নিজের ঘরের কোন লোককে থাকতে দেয় না। সবাই একা। ডাক্তার নার্স আমাদের ভগবান। আমাদের আপন লোক। ওদের সাথেই আমাদের জীবন চলছে। মৃত শরিরটা ধীরে ধীরে নিয়ে যাচ্ছে কিছু নার্স । পাশের পেশেন্ট হাউ হাউ করে কাঁদছিল।

কতদিন আর থাকতে হবে জানি না। রাতে সত্যিই খুব ভয় হয়। ওমনি যেন আর দেখতে না, হয় ঠাকুর সবাইকে ভালো করে দাও ভগবান । সকালে সুইপার ঘর পুছতে পুছতে বলল, তোমার মা কাল এসেছিল । আমি ঘরে চলে যেতে বলেছি। বলেছি ঘরে যান মাসিমা, আপনি জার্ম বয়ে নিয়ে যাবেন। ঘরের বাকী গুলো আর বাঁচবে না। আপনি যান আপনার মেয়ে আর কদিন পর ঘরে চলে যাবে। ঠিক হয়ে যাবে। আপনি যান--

আমার শুনে চোখের কোনা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। কত দিন মাকে দেখি না। আমাদের কেবিনের কোন জানলা দরজা খোলা নেই। কোভিড কেবিন ত, তাই। না হলে মাকে জানলা থেকে দেখতে পেতাম। মা হয়ত একা একা কান্না করতে করতে চলে গেছে। মার ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। খুব অসহায় লাগছে নিজেকে। মা হয়ত ভাবছে, মেয়েটাকে আর দেখতে পারব কিনা কে জানে ? মার কথা ভেবে আমিও কাঁদতে থাকলাম। আমার ছোট বোনটা, দাদা-বৌদি, রুণু আর রৌনক। ওদের সবার কথা মনে হচ্ছিল আর কাঁদছিলাম। অনেক ক্ষণ কাঁদার পর কখন যেন কান্না থেমে গেছিল নিজেই ভুলে গেছি।

আজ আবার একটা নতুন পেশেন্ট এল। কমছে আর না। একের পর এক আসছে--বাড়ি আর কজন যায়? সবাইকে ত দেখি মুখ ঢেকে বাইরে নিয়ে যায়। আমারও কি ওমনি হবে ?

মনে পড়লেই শিউড়ে উঠি। হয়ত ঘরের আর কাউকে আমি আর দেখতে পাব না।

নতুন পেশেন্টটার অনেক নল লাগানো। অক্সিজেন সিলিন্ডার, সেলাইন, নীচে একটা থলেও ঝুলছে। নিথর হয়ে শুয়ে আছে।

আবার দুজন পেসেন্ট এক সঙ্গে এল। তার মানে মহামারী বেশ বড় আকারে ধারন করছে।

একটু পরপর মেডিকেল ভ্যানের আওয়াজ পেতাম। এখন এখানেও তাই দেখছি। এক জনের খুব শ্বাস কষ্ট, বুকে ঘো ঘো আওয়াজ হচ্ছে। আর এক জন আমার মত কোভিড ধরা পরা মাত্র এখানে চালান হয়েছে। যার শ্বাস উঠেছে ওর আর অক্সিজেন লাগানো হয়নি। এমনি হলে আজই সটকাবে। লোকটার পেটটা খুব উপরে যাচ্ছে আর নীচে আসছে। ইসসস তার অবচেতন মন শ্বাস নিতে কত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ভাবলাম তাড়াতাড়ি ছুটি পাব তা আর হল না। ঘরে যাব না কোথায় যাব ভগবানই জানে। ওষুধ পত্র ইনজেকশন সব আবার নতুন করে শুরু করতে হল। মন ভেঙ্গে গেল, এবার আমি আর মনের জোর পাচ্ছি না। আমার চোখ ফেটে জল আসতে লাগলো। আমি কাঁদতে কাঁদতে জ্বরে বেহুঁশ হয়ে গেছি।

কখন ঘুমিয়ে পরেছিলাম তা জানি না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখি জানালা দিয়ে পূর্ণ চাঁদ দেখা যাচ্ছে। পূর্ণিমার রাতের শেষ রজনী। কিন্তু কি উজ্জ্বল আলো। কাঁচ তাকে ঢেকে রাখতে পারে নি। কি উজ্জ্বল আলো ! আমার মুখের উপর পড়েছে। তাই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। চাঁদটাও বেশ বড় লাগছে। আমি ভালো করে তাকাতে পারছি না। এত তেজে আমার চোখ থেকে জল আসছে। খুব কষ্টে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে। দেখি চাঁদটা বড় থেকে আরো বড় হয়ে গেল। একি ! আমি কি দেখছি ? চাঁদের ভিতর যে মা সারদা, চাঁদের আলোর পথ ধরে নেমে এসেছে । আমি উঠে মাকে প্রণাম করব বলে কাছে যেতেই মা দুহাত তুলে আমায় আশীর্বাদ করলেন। আমি খুব চেষ্টা করে যাচ্ছি কাছে গিয়ে মার পাটা জড়িয়ে ধরব। কিন্তু তা পারছি না, নিজে জোর করে উঠে বসতেই দেখি চাঁদটা অস্ত যাচ্ছে। আর আমার মার পাটা ছোঁয়া হয়নি। তখন আমি পুরো পুরি জেগে ওঠে বসেছি। আর আমার জ্বর নেই।

দেখলাম, রাতের পেশেন্টটাকে মুখ ঢেকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে।

অস্তগামী রাতের ঐ চন্দ্রমাকে প্রণাম করে বললাম, মা আর দেখতে পারছি না। এবার যেন ঘরে চলে যাই। আর এ সব দেখতে পারছি না।

সকাল হলেই নার্স এসে বলল, আজ তোমায় ছুটি দেওয়া হবে, তোমার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে-- 

কাল যে জ্বর এসেছিল তার কি হবে ? মনের কথা মনেই রেখে তৈরী হলাম বাড়ি ফেরার জন্য। নার্স কিন্তু বলে চলেছে, শরীর ত দূর্বল তাই ভাল খাবার না হলে গা গরম হতে পারে। ভালো খাওয়া দাওয়া করলে ঠিক হয়ে যাবে। আমি ফিরে এলাম ঘরে। চাঁদের মাকে হাত জুড়ে আবার প্রণাম জানালাম।

                                            সমাপ্ত



No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয়--

সম্পাদকীয়--   চলমান জীবনের নিয়ম সৃষ্টির বাঁধনে বাঁধা। সাহিত্য মানুষের সুখ-দুঃখ ভাব ভাবনা স্মৃতি স্বপ্ন সবকিছু মিলিয়ে সৃষ্ট হয়। আর এ সব কি...