Tuesday 28 September 2021

তাপসকিরণ রায়ের কবিতা--স্বপ্নের বেসাতি, গল্প--রমাকান্ত নামা—জীবন রসায়ণ


তাপসকিরণ রায়ের কবিতা--


স্বপ্নের বেসাতি

জালনা দিয়ে গড়িয়ে আসছিল এক চিলতে জ্যোৎস্না--

স্পট-লাইটের আড়ালের দৃশ্যগুলি আস্তরণে ঢাকা থাকে, 

সান্নিধ্যে অসুখ নেই--তোমার দেহের সঙ্গে কল্পনা জুড়তেই হয়।  

আসলে জীবনের অলংকারগুলি নারীর ভূষণ।

কখনো স্বপ্নের বেসাতিতে বেঁচে থাকে-- 

তুমি তা ছেঁকে নিতে নিতে... 

বৈদুর্য নিভে যাওয়া কক্ষের কুঠুরি ঘেঁষে 

নোংরা কাঁথা ও স্বল্পালোক ল্যাম্প লাইটে 

প্রতিদিনের সংসার পাতে বেসাতি মেয়েরা।

গন্ধ থেকে উৎকট নষ্ট মেয়েদের ঘ্রাণ উঠে আসে।

সেই মেছো গন্ধের মাঝেও নেচে ওঠে এক টুকরো চাঁদ। 

মেঘলা মনের জীয়নকাঠি নড়ে ওঠে, 

হায় রে শরীরবস্তু ! যে তরতাজা দুদিনের, 

তারপর সংকীর্ণ গলির মেয়েদের পায়ের তলা নেই, 

মাথার ওপর নেই, মাঝখানে তাদের 

লজ্জা ও সজ্জাভূমি পড়ে থাকে । 

তবু দিন যায়, রাত আসে--

গলির বুড়ো কুকুরটা একদিন 

কুণ্ডলী পাকিয়ে ওমের আশে মরে পড়ে থাকে।


গল্প

 রমাকান্ত নামাজীবন রসায়ণ   

                            

যদি ফুরফুরে হওয়া ছাড়ে তবে রমাকান্ত কি করবেন ? মাঝে মধ্যে এমনি হয়, একলাটি ঘরে বসে থাকলে কোন দিন হয়ত দুপুর পেরিয়ে আকাশ মেঘলা হয়ে ওঠে আর বৃষ্টি আসার আগেই হওয়া ছেড়ে দেয়। সে ঝড় হাওয়া নয়, বেশ মেজাজি ফুরফুরে হওয়া ! তখন রমাকান্তর মাথার কয়েক গাছ চুলও বেশ এলোমেলো উড়তে থাকে। 

বয়সকাল অনেক আগেই হারিয়েছেন তিনি। স্ত্রীর বিয়োগ হয়েছে আজ প্রায় বছর পনের হতে চলল। শুরুর দিকে খুব খালি খালি লেগেছে। তারপর ওই লিখতে লিখতে লেখক হয়ে যাবার মত একলা থাকতে থাকতে তিনি অনেকটা একলাচোরা হয়ে পড়েছেন। আগে স্ত্রী, শৈলবালার কথা অহরহ মনে পড়ে যেত। যখন তখন সেখানে সেখানে একটা খালি খালি ভাব শরীরের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত। আজকাল অনেকটা হালকা হয়ে গেছেন তিনি। তবু বছরের কয়েকটা দিন আসে মন বড় আনচান করে ওঠে--বাগানে শেফালী আর বনে কাশ ফুল ফুটলে, প্যান্ডেলের ঢাকের শব্দ কানে এলে কিম্বা ওই উদাসী ফুরফুরে হাওয়া বইলে 

--এমন মন মরা হয়ে বসে থাকলে হবে ? হঠাৎ ঝিম অবস্থা ভেঙ্গে চমকে উঠলেন রমাকান্ত--   কে ? কে ? কে কথা বলে ওখানে ? একদম শৈলবালার গলা যেন ! মাঝে মাঝে এমনি হয়--সত্তরের টান ! সময় নাকি মানুষের স্বর্গ মর্ত্যের মাঝখানের অবস্থান হয়। রমাকান্ত জানেন ওটা স্বর্গ মর্ত্য হবে না, ওটা হল ইহলোক পরলোক। সময় কিছু কিছু টান সব দিক থেকে পাওয়া যায়। এক দিকে পরলোক থেকে স্ত্রীর ডাক যেমন শোনা যেতে পারে ঠিক তেমনি ইহলোকের প্রকৃতিও তোমাকে ডাক দিয়ে যেতে পারে 

আখির সব কিছু ছেড়ে চলে যেতে হয়। এই চামড়া মাংস হাড়ের শরীর ছেড়ে চলে যেতে হয়। শরীর হল গিয়ে মানুষের বেশ-পোশাক। ঠিক এমনি সময় রমাকান্তর ধ্যান ভঙ্গ হল তিনি দেখলেন স্বয়ং নষ্ট প্রেমিকা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে ! 

--কি রমা দা--তুমি কিসে এত বিভোর হয়ে থাক ? এই সেই শ্যামলী যে কিনা রমাকান্তর সরা জীবনে বলতে গেলে প্যাঁচিয়ে পুঁচিয়ে রয়ে গেছে একে নিয়ে বেশ কিছু ঘটনা রমাকান্তের জীবনে ঘটেছে। তিনি জানেন এসব সংযোগ। যখনই রমাকান্ত নিজেকে একলাটি অসহায় মনে করেছেন ঠিক সে সময়টাতেই এসে হাজির হয়েছে তাঁর এই নষ্ট নীড় ! কিন্তু ওই এক ব্যাপার, মাঝে মধ্যে বাইরের দরজা দিতে তিনি একদম ভুলে যান। এই কারণে সে দিন যেমন কুকুর কাণ্ড ঘটে গিয়ে ছিল !  

--কি হল, এত দিন পরে কোত্থেকে ? রমাকান্ত প্রশ্ন করলেন। 

হাসল শ্যামলী, এখন এই বয়সেও শ্যামলীর গাল ঈষৎ লাল হতে দেখলেন রমাকান্ত। তিনি ভালো করে তাকালেন ওর দিকে এক বৃদ্ধা, হ্যাঁ বৃদ্ধাই  তো, বসয় ষাট পার করেছে। তবে হ্যাঁ, এখনও ফিটফাট রাখা শরীর। মনকে খোলা রাখে , লতাপাতার বেড় যথা সময় ছাঁটিয়ে নেয়। উদার উদাস আপন ভোলা মহিলা! কাউকে ক্যাত্কুত দিয়ে কিছুই জানান দেয় না।

শ্যামলী বলে উঠল, চলে এলাম বৃন্দাবন থেকে। 

--কেন ? কোন গোশাই মেলেনি বুঝি ? রমাকান্তর মুখ থেকে ফস করে কথাটা বেরিয়ে গেল। 

--কি বলছ রমাদা ! বয়স তোমার কত হল বল তো ?

--বয়স কি মানুষের অভ্যাস চলন বলন ধরে রাখতে পারে ?

উত্তরে শ্যামলী কিছুই বলল না, সামান্য হাসল মাত্র বোধহয় নিজের বয়সের কথা তার মনে পড়ে গেল  অথবা বৃন্দাবনের কোন বিরহ কথা! রমাকান্ত দেখেছেন শরীরের চেত বোধ ভোঁতা হয়ে গেলেও মানুষের স্বভাব অভ্যাসের ধরন যায় না। আর তা ছাড়া শরীর আর মনের গতি এক প্রকার হয় না। বরং লোকে বলে বুড়োরা নাকি আরও বেশী রসিক হয়। রমাকান্তর বয়সের কমজোরি আছে ঠিকই, আসলে মানসিক দিক থেকে তিনি বুড়িয়ে যান নি। তবে আত্ম হনন যখন করা যাবে না তখন সময় কিল করতে কিছু না কিছু তো করে যেতেই হবে এমনিতেই একা মানে বোকা, একা মানে বোবা-- কাঁহা তক নিজের সঙ্গে নিজের কথা চলতে পারে ?

--এই রাম দা, আমার কথা শুনছ না তুমি--কি ভাবনায় মত্ত ? শ্যামলী রমাকান্তর গায়ে ঠেলা দিয়ে বলে উঠলো। 

সত্যি, কথাবার্তা বলতে না পেরে তিনি নিজের মধ্যেই চিন্তা করে যান, নিজের সঙ্গেই কথা বলে যান। সেখানে তিনি একলা নন, জীবনের কাজের মানুষগুলিও জুটে যায় বর্তমানে ফিরে এলেন তিনি, হ্যাঁ, বল কি বলছ ?

--তুমি তো একা থাক--ঝুট ঝামেলা তো কিছু নেই--তবে এত চিন্তা কিসের ? শ্যামলী বলে ওঠে। 

--একাই তো ভয়ের কারণ ?

--মানে?--যেন ঠিক অনুধাবন করতে পারল না শ্যামলী, মরে যাবার ? 

--এটাই তো জীবনের চরম ভয়, যদিও আমরা আপ্রাণ তাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করি। যদিও রবীন্দ্রনাথ এক জাগায় বলে ছিলেন, তুঁহু মম শ্যাম সমান !

--হ্যাঁ, এবার তোমায় মানাচ্ছে--এমনি কথা বল, মৃত্যুকে স্বাভাবিক ভেবে নিয়ে জীবনের ভাবনা ভাবশ্যামলী বলল। 

রমাকান্ত বললেন--জীবন চলমান, তাকে সাজিয়ে নেওয়া--কি ভাবে সাজাবে তা নিজের কাছে--

--সব সময় নিজের কাছে থাকে না রমা দা, নিয়তির প্ররোচনা বড় জেনো--আমার জীনটাই দেখো না! দোষগুণ মিলেই তো মানুষ, রমা দা ! আমার কামড়ে দেওয়া একটা মানসিক রোগ আমি জানি জানি ব্যাপারে আমি সাইকো

-- সব কথা তুলে লাভ কি ? তুমি একটু বিশ্রাম কর আমি বরং স্নান সেরে  আসি আজকাল রমাকান্ত কিছু সময় ধ্যানে বসেন, চেষ্টা করেন ধ্যান ধারণায় মন দিয়ে কিছু সময় ব্যতীত করতে 

--কি ব্যাপার তুমি, তুমি ধর্ম কর্মে মন দিয়েছ নাকি ?

--কি করব--জীবন কাটাতে হবে তো--দুঃখকে সব সময় যতটা দুরে সরিয়ে রাখা যায়। তুমি বিশ্রাম কর, আর কথা না বাড়িয়ে রমাকান্ত স্নান করতে বেরিয়ে গেলেন

স্নান সেরে রমাকান্ত ঠাকুর ঘরে বসে আছেন। পূজা-আচ্ছা বন্ধ হয়েছে বহুদিন, শৈলবালা মারা যাবার পর থেকে দুঃখে-শোকে তিনি আর ব্যাপারটা ধরে রাখতে চাননি। আজ আর ধ্যানে মন রাখা যাচ্ছিল না। শ্যামলীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। শ্যামলী, তাঁর জীবনের উপ নায়িকা তো বটেই, জীবনের মোড়ে মোড়ে  ওর সঙ্গে সাক্ষাত। ওর প্রতি দুর্বলতা আছে রমাকান্তর। অনেক রংবেরঙের ভাবনা ওকে নিয়ে একসময় মনে রচিত হয়েছিল। সে রং বেশী দূর চড়ে নি সেটা অবশ্য শ্যামলীর সাইকো মনের জন্যে। দুর্দান্ত মুহূর্তগুলিতে নায়ককে সে কামড়ে দেয়। মানসিক রোগের কারণেই তার বিয়ে টেকেনি--কাউকে ভালবাসা নিবেদন করতে পারেনি। এও তো এক অভিশপ্ত জীবন !

আজ দুজনেই বৃদ্ধ বৃদ্ধা। আলাদা ভাবে ওদের জীবনগুলি ছন্নছাড়া, খণ্ডাংশ বলা যায় তবু মন, তাকে ধরে রাখা যায় কৈ ? না আজ কিছুই হচ্ছে না--ধ্যান ধারণায় কিছুতেই মন লাগাতে পারছেন না রমাকান্ত চোখ খুলতেই অবাক হলেন তিনি, শ্যামলী তাঁর একেবারে কাছটিতে বসে তাঁর দিকেই মোহিত নয়নে তাকিয়ে আছে!  

--কি হল ? রমাকান্ত মুখ খুললেন। 

--তোমায় দেখছি, রমা দা! মানুষ যখন স্থির ভাবে বসে থাকে তখন তার মধ্যে শুদ্ধশীল এক মানুষের প্রকাশ ঘটে। 

--আচ্ছা আমি তা হলে এখন শুদ্ধ শুচিময় ?

--না, এখন আবার তুমি পুরুষাকারে জেগে উঠছ! 

রমাকান্ত আর শ্যামলী বড় কাছাকাছি বসে আছে। ওদের পরস্পরের শ্বাসপ্রশ্বাস পরস্পরের মুখমণ্ডলে এসে লাগছে। ক্রমশ: বৃদ্ধ বৃদ্ধার শ্বাস মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে--একজন আর একজনের দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু তাকিয়ে আছে। সময়টুকু গোনার বাইরে। চারদিক শুধু মাত্র স্তব্ধতায় ঘিরে আছে 

                                        সমাপ্ত     


No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয়--

সম্পাদকীয়--   চলমান জীবনের নিয়ম সৃষ্টির বাঁধনে বাঁধা। সাহিত্য মানুষের সুখ-দুঃখ ভাব ভাবনা স্মৃতি স্বপ্ন সবকিছু মিলিয়ে সৃষ্ট হয়। আর এ সব কি...