Sunday, 3 October 2021

সাবিত্রী দাসের কবিতা ও গল্প--কবিতা--১ বার কেউ মরে নাকি ২ জানি না, গল্প--মনঃ সমীক্ষক



সাবিত্রী দাসের কবিতা ও গল্প--

কবিতা--


বার বার কেউ মরে নাকি


একে একে পার হয়ে যায় দিনগুলি,

 পৃথিবী চলে তার নিজের ছন্দে।

অতন্দ্র প্রহরায় জেগে থাকি,

   নিশাচর এক। কিছুই কি নেই বাকি?


বুকের ভেতর থেকে তারা খসার মতো

  এক এক করে খসে পড়ে  স্মৃতির দল

সুরভিত আম্রমুকুল।

ধ্বস নামে বুকের গভীরে

কিছুই কি নেই  আর বাকি?


অপেক্ষা  কিসের তবে আর ,

কেন বৃথা এত কাঁটা-ছেঁড়া !

মানুষ কী বার বার মরে নাকি?


জানি না



কতদিন দেখি নি তোমায়!

    ভোরের শিশিরে ভেজা জুঁই।

আজ ও কী তেমনি আছো?

     ছিপছিপে বেতস লতা ! হাস্নুহানার গন্ধে!


হয়তো আজ তুমি মা হয়ে গেছো,

     স্নেহঝরা মুখ,আদরে-চোখের পাতায়!

সদা সশঙ্কিত, উচ্চকিত,ব্যাকুলিত প্রাণ।

    স্নেহময় ,মায়াময় পুরাণ!


খুঁজে  আর পাবো কি  তোমায়?

     শিশির সিক্ত হারানো জুঁইয়ের গন্ধে!

ভোরের স্নিগ্ধ ছায়ায়।



সাবিত্রী দাসের গল্প--

মনঃ সমীক্ষক

   

সারাটা রাত দুচোখের পাতা এক করা দূরে থাক,স্থির হয়ে বসতে পর্যন্ত পারেন নি তিনি।আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মনঃ সমীক্ষক  ডাঃ সুশোভন বিশ্বাস সারা রাত ধরে  নিজেই নিজের আত্মসমীক্ষা করে গেছেন,একেবারে চুল চেরা বিশ্লেষণে ।লোকে হাসবে না!সুশোভন বিশ্বাসেরও মনঃ সমীক্ষনের দরকার হয় তাহলে ! মানবে কেউ?  

    গতকাল সন্ধ্যায় তার সম্বর্ধনা ছিল। আলোয় আলোময় মঞ্চ। টেবিল ফুলের স্তবকে ভর্তি বারংবার উঠে আসছে তার  সাফল্যের কীর্তিগাথা।এসবের মাঝে ফুলের সৌরভে, নামের মন্ত্রে, নিজেকে বেশ দেবতার মতো মনে হতে লাগলো।ডাঃ সুশোভন বিশ্বাস  প্রথিত যশা মনঃসমীক্ষক।আবাল বৃদ্ধ বনিতা যে কাউকে যে কোন ধরনের মানসিক জটিলতা কাটিয়ে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার সাফল্য যার আকাশ ছোঁয়া।এখানেই শেষ নয় , আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু মনস্তত্ত্বের বিভাগীয় প্রধানও তিনি। সাফল্যের খতিয়ান তার কানায় কানায় পূর্ণ।কানায় কানায় পূর্ণ আজকের সভাগৃহ। মনের অন্ধকার কাটিয়ে আলোর জগতে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে উপচে পড়ছে ভিড়।সেই আনন্দের সৌরভে বুঁদ হয়ে বাড়ী  ফিরলেন। আজ বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়েছে তাকে ,যা পেতে পেতে লেগে যায় সম্পূর্ন  জীবন। মন তার সাফল্যের আলোয় আলোকিত।জীবনটা সত্যিই সার্থক! ভাবতে ভাবতে বেশ উৎফুল্ল মনেই নামলেন গাড়ী থেকে।  

     গাড়ি থেকে নেমে দোতলার দিকে তাকিয়ে দেখেন অন্ধকার।এসময় তো অন্ধকার থাকার কথা নয়! মায়া কোথায় ! তাছাড়া টুটুল! ওহহ ভুলেই গেছিলেন আজ টুটুলের বার্ষিক পরীক্ষার ফল বেরোনোর কথা।এরা  যে কি করে না! এরকম অন্ধকার করে রাখার কোনো মানে হয়?গজগজ করতে করতে উপরে এসে দেখেন তালাবন্ধ।এসময় কোথায় গেল মায়া!রাত দশটা বাজে! বড়ো বিরক্তি বোধ করলেন, এই আনন্দের দিনে......

   ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে ফুলের স্তবক ,মানপত্র টেবিলের উপর রাখতে গিয়ে দেখেন টেবিলে পেপার ওয়েট চাপা দেওয়া ভাঁজ করা কাগজ একখানা।খুলে দেখেন, মায়া লিখেছে-"জানি না তোমার মনে আছে কিনা! আজ টুটুলের রেজাল্ট ছিল।আশ্চর্যের ব্যাপারকী জানো,  টুটুল! আমাদের ছেলে টুটুল ,পাশ করতে পারেনি। টুটুলের দিকে তাকিয়ে দেখি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।

বললাম "এমন হলো কেন?" কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে সারাক্ষণ শুধু  কেঁদেই গেছে।তোমার খ্যাতি প্রতিপত্তি সব তোমারই থাকুক।এখন থেকে টুটুল শুধু আমার ছেলে হয়েই বাঁচুক।আমি জানি তোমার  খ্যাতির কাছে আমরা কেউ না, কিছু না!প্রতিটি মুহূর্ত তোমার অপেক্ষায় যেমন আমি থেকেছি,টুটুলও তাই!   আমার  দোষও তো বড়ো কম  ছিল না। আমি তোমার কাছে বঞ্চিত হচ্ছি এমন ভাবনা ভাবতে ভাবতে অজান্তেই টুটুলের ওপরও যে অবিচার করিনি এমন নয়।স্বার্থপরের মতো নিজের বঞ্চনার কথাই ভেবে গেছি! কিন্তু টুটুল! আমি টুটুল কে নিয়ে বর্ধমানে মার কাছে চলে যাচ্ছি।" চিঠিটা হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন তিনি। 

অন্ধকার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন ।এই মুহুর্তে নিজেকে বড়ো অসহায় মনে হচ্ছে তার ।বুকের ভেতর একটা মোচড় অনুভব করলেন।

মনে পড়ছে....অনেকদিন আগে টুটুল  একবার বলেছিল "বাবা তুমি কাছে থাকলে আমার  না খুউব ভালো লাগে ,খুউউব!" কতোদিন সে কতো...দিন! দিন কোথায় কয়েক বছর । নিজের কাজ,গবেষণা,ছাত্র ছাত্রী,এসব নিয়েই মেতে থাকত  দিনের পর দিন , রাত। নিত্য নুতন কেস স্টাডি করা,বিশ্লেষণ করা ,আর আজ এই অন্ধকারে নিজেকে বিশ্লেষণ করে দেখছে সে,এই যে খ্যাতি! আকাশ ছোঁয়া সাফল্য তাকে ব্যঙ্গ করে বলছে," কি হলোতো! কিসের বিনিময়ে এসব পেলে? কিছু পেতে গেলে কিছু তো হারাতেই হবে,জানো না!" না না টুটুল ,মায়া এদের হারিয়ে সে বাঁচবে কেমন করে!আজ ওরা নেই বলে এই আনন্দ যে সত্যিকারের আনন্দ হয়ে উঠতেও পারলো না। 

নাঃ অনেক অবিচার তিনি করেছেন,আর নয়! ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।টেবিল থেকে মহার্ঘ্য পুষ্প স্তবক গুলি নিয়ে একের পর এক ব্যালকনি থেকে ছুঁড়ে ফেললেন সোজা আস্তাকুঁড়ে।সম্মাননা পত্রটি তুলে নিয়ে সেটির উপর পরম মমতায় হাত বোলাতে বোলাতে তাকিয়ে থাকলেন স্থির দৃষ্টিতে। ছিঁড়তে গিয়েও ছিঁড়তে পারলেন না।সেদিকে তাকিয়ে বুক ঠেলে  একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে  এলো,চোখ থেকে দুফোঁটা জলও কী!অন্ধকারে ঠিক  বোঝা গেল  না। আলমারী খুলে রেখে দিলেন সযত্নে। আত্মস্থ হলেন। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তিনি।

   এবার বেরোতে হবে। নাঃ আর দেরী নয় ! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বর্ধমানে গিয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে মায়া  আর টুটুলকে । টুটুল তারই  সন্তান ,আত্মজ!  তার ব্যর্থতার দায় যে   তারই  ! কাছে থেকে সাহস যোগাবেন তাকে ।   শুধু টুটুলই নয় ,এ কবছর মায়ার ওপরও তো অবিচার বড়ো কম হয়নি! বুকের ভেতরটা প্রবল এক আলোড়নে আলোড়িত হতে থাকলো। আকাশে তখন  সবে  নূতন প্রভাতের আলো  দেখা দিয়েছে।


 

No comments:

Post a Comment