Thursday 7 October 2021

বিকাশ ভৌমিকের গল্প-- ভূত নয়, অশরীর


বিকাশ ভৌমিকের গল্প-- 

ভূত নয়, অশরীর

 

শ্মশানঘাটে দাহ সংস্কার করতে গিয়ে এক বন্ধু বলেছিল ভূত বলে কিছু হয় না, কিছুই নেই।

ভৌতিক কিছু লিখতে বসে ভাবলাম আমি যা অনুভব করি সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরা যাক। যার সান্নিধ্য আমাকে শিহরণ জাগাতে বাধ্য করেছে, আমার অনেক রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, তাকে জানার বোঝার কোন ক্ষমতা আমার নেই। সেই অজানা অশরীরীর কিছু ঘটনা উল্লেখ করছি--

ধু ধু করা মাঠের মাঝখানে মাথা গোঁজার মতো একটু জায়গা কিনে ঘর  বানাতে যখন কাজ আরম্ভ করি তখন লক্ষ্য করেছি এদিক-ওদিক কয়েকটি ঘরবাড়ি ছাড়া সব ফাঁকা মাঠ। অনুপযুক্ত জমিতে গাছ গাছালিও নেই। থাকার মধ্যে ছিল কয়েকটি বড় বড় আম নিম বট অশ্বত্থ গাছ। আর ছিল নির্মাণাধীন আমার ঘর থেকে দু আড়াই শ’ মিটার দূরে একটা বিশাল খেজুর গাছ। ঘর থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে উঠতে হলে সাইকেল চলার মত পথেই এই খেজুর গাছের তলা দিয়ে যাওয়া-আসা করা এক মাত্র পথ অবলম্বন ছিল। 

ওই পথ ধরেই আমি সাইকেল চালিয়ে যাওয়া আসা করি। অফিস থেকে ফেরার সময় সেই প্রথম অনুভব করলাম বড় রাস্তা ছেড়ে--

সরু পথ ধরে ঘরের দিকে অগ্রসর হতেই মনে হল কেউ লাফিয়ে সাইকেলে চেপে বসেছে। সাইকেলের ব্যালেন্স টালমাটাল হয়ে যায়। সামনে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দেখি--কাউকেই বসে থাকতে দেখি না।  দম লাগিয়ে ঘরের কাছে আসতেই স্পষ্ট বুঝতে পারি কেউ লাফ দিয়ে নেমে গেল। সাইকেলের ভারও হালকা হল। এভাবেই সে রোজ আমার সাইকেলে চেপে আমাকে ঘর অবধি ছেড়ে দেয়। প্রথম প্রথম একটু ভয় পেয়েছি, পরে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

দিন যায় মাস যায়, বসতি বাড়তে থাকে, ঘর-বাড়ি নির্মাণ হতে থাকে। দেখতে দেখতে মাঠ পরিবর্তিত হয় গ্রাম থেকে নগরে। বড় বড় গাছ কেটে রাস্তা তৈরি হয়। তবে খেজুর গাছটা আজও বহাল তবিয়তে বিরাজমান। আমার বদ্ধমূল ধারণা হয়--ওই খেজুর গাছ তাতেই ভূত-প্রেত অশরীরী যেই হোক না কেন তারই বাসস্থান। পাকা রাস্তা তৈরি হওয়ায় আমি আর খেজুর গাছের তলা দিয়ে যাই না।  ফলে আমার সাইকেলেও কেউ চাপে না।  আমি কিন্তু অফিস থেকে ফিরে এসে রোজ--সন্ধ্যে বেলায় খেজুর গাছের তলা দিয়ে হেঁটে যাই। হেঁটে যাওয়ায় তেমন কিছুর আভাস পাইনি।  কৌতূহল হয় তাই এখনও হেঁটে যাই।  তবেএ  কথা বলতে পারবো না--আমি আমার ইচ্ছা শক্তিতে যাই না আমাকে বাধ্য করে ওই পথে যাওয়ার জন্য !

গভীর রাত, রাত প্রায় দেড়টা। ঘন অন্ধকারে গা ছমছম করছে শ্মশান যাত্রী বলতে মাত্র ছয় জন। একটা পাথরের বেঞ্চে আমি বন্ধুদের সাথে বসে গল্প করছি। বাকিরা জ্বলন্ত সব দেখছে। ল্যাম্পপোস্ট মাত্র দুটো, তাতে আলো টিমটিম করছে। একে অপরের চেহারাও সঠিক দেখা যাচ্ছে না। এ কথা সে কথার পর ভূতের কথার প্রসঙ্গ উঠলো। ভূত নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক হল। সে কিছুতেই মানতে চায় না। তার এক কথা, ভূত বলে কিছু হয় না, কিছুই নেই, সব গরন্ত  কাহিনী মাত্র। আমি যত তাকে বোঝাতে চাই, সে তার প্রতিবাদ করে। শুধু আমাকে মারতে বাকি রেখেছে। অবশেষে আমি হাল ছেড়ে দিয়ে অযথা তর্ক থেকে বিরত থাকি। তবু সে থামে না পাথরের বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমার মুখোমুখি হয়ে একনাগাড়ে বলে চলেছে--এ অসম্ভব, হতেই পারে না, আমি বিশ্বাস করি না ভূত বলে কিছু আছে…..ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ দেখলাম সে গালে হাত দিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ল।  নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তুই আমাকে মারলি ?  আমি বললাম, আমি কখন মারলাম, আমি তো বেঞ্চে বসেই আছি। তোকে মারতে হলে তো আমাকে উঠে দাঁড়াতে হবে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তার বোধগম্য হল। সে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আমার গা ঘেঁষে এসে বসে বলল,   ভাই, আমার ভয় করছে, আবার যদি মারে। তাকে শান্ত করে বললাম, ভয় পাস্ না, ক্ষমা চেয়ে নে দেখবি আর কিছু করবে না। শুকনো মুখে কাচুমাচু হয়ে বলল, হে অশরীরী আমায় ক্ষমা করে দাও আমি অবুঝের মত কথা বলেছি-- আর কখনো এভাবে বলব না আমার আমার বিশ্বাস হয়েছে।

একদিন অফিস থেকে ফিরতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে এমন সময় একটা অটো আমার সাইকেলে ধাক্কা মারলে আমি সাইকেল সহ আছাড় খেয়ে পড়ি। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই অটোটা স্টার্ট দিয়ে পালাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে কিন্তু অটো একটুও এগোয় না। ব্যাপারটা দেখতে আমি এগিয়ে যাই অটোচালক নেমে এসে দেখে অটোর সামনের চাকার মাড গার্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চাকার সাথে আটকে গেছে। আমি অবাক হই ক্ষয়ক্ষতি যা  হবার আমারই হবার কথা এমনটা কি করে সম্ভব ? বুঝতে দেরী হল না, এ আমার বন্ধু অশরীরীর কাজ।

আরেক দিনের ঘটনায় আমার গুরুতর আঘাত অবধারিত ছিল। হয়ত মৃত্যুও হতে পারত। বিকেলে মোটরসাইকেলে ঘুরতে বেরিয়ে রাস্তায় কিছু দূরে দেখি হাজারে হাজারে মানুষ যে যার যানবাহন নিয়ে বিরাট গোলাকার রাস্তা ঘিরে আছে। ট্রাফিক জ্যাম। আমিও মোটর সাইকেলে একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম তিনটা প্রকাণ্ড ষাঁড়  একে অপরের সাথে লড়াই করছে। সাঁড়েদের থামায়  কার  সাধ্য। হঠাৎ একটা ষাঁড় পরাস্ত হয়ে আমার দিকে প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসে। আমি মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে পালাবার মতো জায়গা পেলাম না। যা হবে দেখা যাবে--এই ভাব নিয়ে ভয়ে  আরষ্ট হয়ে আছি। হঠাৎ কি যে হল ষাঁড়টা তীব্র বেগে এসে প্রচন্ড ব্রেক কষে আমার হ্যান্ডেল মাথা ঠেকিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে, যে ষাঁড়টা তাড়া  করেছিল তাকে আক্রমণ করতে ছুটে যায়। আমি অবিশ্বাস্য ভাবে বেঁচে যাই।

বাইরে বেরোলে রাস্তায় নানা ঘটনা ছাড়াও লক্ষ্য করেছি সে ঘরেও সব সময় আমার সাথে সাথেই আছে। আমি সাধারণত সকালে ঘর থেকে বের হলে ঘরে ফিরতে দুপুর দেড়টা দুটো বেজে যায়।  সে দিন কোন কারণে বিশেষ দরকারে আমি আধ ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে এসে দেখি দরজায় তালা দেওয়া। শ্রীমতি হয়ত কোন কাজে তালা লাগিয়ে চাবি নিয়ে চলে গেছে। আমি হতাশায় অনেকক্ষণ ধরে এখানে ওখানে, যেখানে চাবি থাকা সম্ভব ভালো করে খুঁজেও যখন পেলাম না তখন শ্রীমতি কে ফোন করলাম। ঘরের চাবি কোথায় ? জবাব এলো, চাবি তো আমার কাছে। আমি ফোন কেটে দিয়ে আবার পায়চারি করতে করতে জানালায় চোখ পড়ল--চাবি পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি চাবি নিয়ে তালা খুলে ঘরে ঢুকে টেবিলে তালা চাবি রেখে আমার দরকারি কাজ সেরে তালা লাগিয়ে চাবিটা জানালায় যেমন ছিল তেমন ভাবেই রেখে দিয়ে বাইরে মোটরসাইকেল স্টার্ট দিতে যাব হঠাৎ কি খেয়াল হল আরেকবার চাবিটা দেখতে জানালায় গিয়ে দেখি চাবিটা নেই। এর মধ্যে শ্রীমতীর ফোন এল, চাবিটা পার্সে খুঁজে পাচ্ছি না। খানিক বাদে আবার ফোন এলো, পেয়ে গেছি ,চাবিটা আমার কাছেই আছে। বুঝতে আমার কিছুই বাকি রইল না আমার অস্বস্তি দেখে সেই অশরীরী শ্রীমতীর পার্স থেকে চাবি নিয়ে জানালায় রেখে দেয়। আমার কাজ হওয়ার পর আবার চাবিটা শ্রীমতীর পার্সে রেখে দেয়। 

এবার তার স্পর্শ অনুভব করলাম। এক রাত্রে সবে তখন ঘুম এসেছে এমন সময় হঠাৎ পিঠে বরফের মত ঠান্ডা হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠলাম। 

মশারি থেকে বেরিয়ে আলো জ্বেলে কাউকে দেখতে পেলাম না। একা শুয়ে থাকার অভ্যাস। শ্রীমতি অন্য ঘরে শুয়ে থাকে আমার তীব্র নাক ডাকার বদ অভ্যাসে। 

এই ঠান্ডা হাতের স্পর্শ এক দু’দিন পর পরই অনুভব করি। ভয় না পেলেও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। ঘন্টার পর ঘন্টা সহজে আর ঘুম আসতে চায় না। এমন কি ভারতবর্ষের যে প্রান্তেই গিয়েছি সেখানেও আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে, আবার অনেক উপকারও করেছে অকল্পনীয় ভাবে। 

অনেক সময় ভাবি--হয়ত সে আমাকে কিছু বলতে চায়, অথচ আমি বুঝতে পারি না। কে সে ? নারী না পুরুষ ? কি বলতে চায় ? কেন সে আমাকেই এভাবে প্রহরীর মত পাহারা দেয় ? কখনও ভাবি কোন তান্ত্রিকের সাহায্য নিয়ে ওকে জানাবার চেষ্টা করি পরে ! পরে ভাবি তান্ত্রিক যদি তার ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে ওকে তাড়িয়ে দেয়, আমি তো তেমনটা চাই না। 

তবুও আমি তার মঙ্গল কামনা করি !

সমাপ্ত

 

1 comment:

  1. গল্প ভালো লাগলো। ভূত নয়, অশরীরী নামকরণও ভালো লেগেছে।

    ReplyDelete